একটা কোম্পানি তার কার্যক্রম গুলো সফলভাবে পরিচালনা করার জন্য সেলস পিপলদের উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সেলস টিম কোম্পানির রেভিনিউ/আয় নিশ্চিত করে থাকে। একটা কোম্পানির সেলস টিম যত দক্ষ থাকবে, সেই কোম্পানি তত লাভজনক ব্যবসা করবে। তাই একজন ম্যানেজারকে খুবই দক্ষতার সহিত সেলস টিমকে নেতৃত্ব দিতে হয়। বাংলাদেশের অধিকাংশ কোম্পানিরাই সেলস টিমের জন্য একটা কৌটা, একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য নির্ধারিত করে দেন। এবং সেই টার্গেট অর্জনের উপরে একটা লোভনীয় কমিশন ও সেট করে দেওয়া হয় যাতে সেলস পিপলরা সেটা অর্জনের আপ্রাণ চেষ্টা করে। কিন্তু সবসময় কি এই টার্গেট আর কমিশন বেইসড সিস্টেম কোম্পানির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে?
গবেষকরা বলেছেন “না”, প্রত্যেকটা মানুষের চাহিদা, অনুপ্রেরণা ভিন্ন থাকে। তাই বলে সবার জন্য আলাদাভাবে কমিশন, ইনসেনটিভ দেওয়া ও ঠিক হবে না। কারণ সেটা খরচ ও সময় উভয়ই বাড়িয়ে দিবে। এই সেলস-টার্গেট-কমিশন নিয়ে অনেক আগে থেকে গবেষণা চলে আসছে। কোম্পানির সেলস ব্যবস্থাকে উন্নত করার জন্য কিছু পদক্ষেপ নেওয়া খবই জরুরী।
সেলস বৃদ্ধির কিছু কৌশলঃ

জটিল কমপেনসেশন সিস্টেম পরিহার করা উচিতঃ কমপেনসেশন হল একজন কর্মচারীর বেতন, কমিশন ও অন্যান্য উদ্দীপনার যোগফল যা মাসিক হিসাবে তাকে দেওয়া হয়। সেলস বৃদ্ধির কৌশলে প্রথমেই আসবে এই কমপেনসেশন সিস্টেম। ইহা এমনভাবে ঠিক করা উচিত যাতে সেটা সহজেই কর্মীদের কাছে অনুমেয় হয়। উদাহরণস্বরূপ, একটা উচ্চ অনিশ্চিত ব্যবসা যেমনঃ ট্যুরিস্ট কোম্পানির সেলস টিমকে যদি বলা হয় তারা প্রতিটা ট্যুর সংগঠিত করলে তারা কমিশন পাবে এবং তাদেরকে একটা নিম্ন ফিক্সড স্যালারি দেওয়া হবে তাহলে সেটা কোম্পানির জন্য খারাপ প্রভাব সৃষ্টি করবে। কারণ ট্যুর বছরের সব সময় হবে না, এটা একটা মৌসুমী ব্যবসা। এই সিস্টেমে বিক্রয়কর্মীরা বছরের কিছু নির্দিষ্ট সময়ই তাদের সর্বোচ্চ দিয়ে কাজ করবে। গবেষকরা বলছেন, যে সব ব্যবসাতে অনিশ্চয়তা বেশি সেগুলোর সেলস টিমকে পুরো বছরই একটা ফিক্সড স্যালারি দেওয়া উচিত। এতে কোম্পানির লাভ বাড়বে। আবার যেসব ব্যবসাতে অনিশ্চয়তার পরিমাণ কম, প্রতিনিয়ত পণ্য বিক্রি হয় সেখানে স্যালারির পাশাপাশি কমিশন দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিলে সুফল পাওয়া যাবে। এই দুইটাকে একসাথে করলে সংঘাতের আশংকা থাকবে।
বিভিন্ন সূতায় আকর্ষণীয় নকশা তৈরী করাঃ একজন দর্জি যেভাবে নিখুত ভাবে বিভিন্ন সূতা ব্যবহার করে কাপড় সেলাই করেন, ঠিক সেভাবে একজন ম্যানেজারকে সেলস বৃদ্ধি করতে বিক্রয়কর্মীদের চাহিদা অনুযায়ী পুরস্কার, অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা নিশ্চিত করতে হবে। যেমনঃ একটা কোম্পানির ৩০ জন বিক্রয়কর্মীদের মধ্যে সবাই হয়ত নগদ অর্থ পুরস্কার হিসেবে নাও চাইতে পারে। কেউ হয়ত নতুন বিয়ে করেছে, তাকে একটা ৩ দিনের ভ্রমণের ব্যবস্থা করে দিলে যে যতটা খুশি হবে নগদ অর্থ দিলে সে ততটা খুশি হবে না। ম্যানেজারকে কর্মীদের জীবনে কি ঘটছে সেটা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে। একেকজনকে একেকভাবে পুরস্কৃত করার কিছু খারাপ প্রভাব ও আছে। ইংরেজীতে একটা টার্ম আছে, “Watercooler effect”- কোম্পানির কর্মীরা কাজের বিরতিতে চা-পান কিংবা নাস্তার সময় নিজেদের মধ্যে যখন কমিশন নিয়ে আলোচনা করবে তখন হয়ত তারা একে অপরের পাওয়া ভিন্ন পুরস্কারের জন্য অনুপ্রেরণা হারাতে পারে। তাই ম্যানেজারকে এই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। স্বচ্ছতা রাখার জন্য পুরস্কার বা উদ্দীপনা সবার সামনেই দেওয়া যেতে পারে, অথবা সরাসরি কর্মীদের মত নেওয়া যেতে পারে যে, পুরস্কার হিসেবে কোম্পানির কাছ থেকে তারা কি প্রত্যাশা করে।
সেলস কর্মীরা ডালে ডালে চললে, ম্যানেজারকে চলতে হবে পাতায় পাতায়ঃ সেলস বৃদ্ধির কৌশলে ম্যানেজারকে বিক্রয়কর্মী থেকে দশ হাত এগিয়ে থাকতে হবে। একটা কোম্পানি ত্রৈমাসিক বা বার্ষিকভাবে বোনাস প্ল্যান করে থাকে সেলস কর্মীদের জন্য। এই জায়গায় সেলস কর্মীরা কিছু চালাকি করে থাকে। বছরের প্রথম চতুর্ভাগে সেলস টার্গেট পূরণ হয়ে গেলে এক কর্মী হয়ত আরেকজনকে তার বিক্রয় স্থান থেকে একজন ভোক্তা ম্যানেজ করে দিতে পারে অথবা বছরের অন্য চতুর্ভাগে বিক্রি করার জন্য বাকি রেখে দিতে পারে। ফলে কোম্পানির ওই চতুর্ভাগে হয়ত সেলস বেশি হতে পারত, কিন্তু চালাকির কারণে সেটা হল না, লস কোম্পানির। আবার অনেক সময় ভাগ্য অনেক বড় কারণ হিসেবে কাজ করে সেলস টার্গেট পূরণ করতে। দেখা গেল একটা কোমল পানীয় কোম্পানির একটা এরিয়ায় কিছু বিদ্যালয়, কলেজ আছে। স্বভাবতই সেখানে সেলস বেশি হবে। এখন ম্যানেজার যদি সেই কর্মীকে অন্য সবার মত একই সেলস টার্গেট বেধে দেন তাহলে সেটা সঠিক টার্গেট হবে না। দেখা যাবে বিক্রয়কর্মী শুয়ে বসে আরামসে সেই টার্গেট পূরণ করে ফেলবে। এখানে কিন্তু তার কোন পরিশ্রম নেই, শুধু ভাগ্যের জোরে সে পুরস্কার পেয়ে যাবে। এর জন্য প্রতিনিয়ত ডাটা এনালাইসিস বা তথ্য বিশ্লেষণ করতে হবে, সেলস বৃদ্ধি করার জন্য। বছরের কোন সময়ে কোথায় সেলস বেশি হচ্ছে, কেন বেশি হচ্ছে।
বিক্রয়কর্মী পুরস্কার পাবার ও পুরস্কার পাওয়ার পরেঃ যেকোন কোম্পানির সেলস বৃদ্ধি করার কৌশলে পুরস্কার অনেক অবদান রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, বিক্রয়কর্মীরা পুরস্কার পাবার আগে যে আগ্রহ, উত্তেজনা নিয়ে কাজ করে পুরস্কার পাবার পরে সেই তুলনায় অনেক কম আগ্রহ নিয়ে কাজ করে। ফলে কোম্পানির বছরের শুরুতে ভাল আয় হলেও বছরের মাঝামাঝি বিক্রি অনেক কম হয়। এই সমস্যা দূর করতে, কোম্পানির সেলস বৃদ্ধি করতে গবেষকরা একাধিক উদ্দীপনা প্রদানের ব্যবস্থা করতে বলেছেন। যেমনঃ
১ম প্রেক্ষাপটঃ একজন বিক্রয়কর্মীকে যদি বলা হয় ১ মাসের মধ্যে, ২০ হাজার টার্গেট পূরণ করলে তাকে শতকরা ২ ভাগ বোনাস দেওয়া হবে।
২য় প্রেক্ষাপটঃ উপরের শর্তের সাথে যদি জুড়ে দেওয়া হয়, বিক্রয়কর্মী যদি ৩০ হাজার বা এর উপরে বিক্রি করতে পারে তাহলে তাকে ৫% বোনাস অতিরিক্ত দেওয়া হবে, তাহলে সেই বিক্রয়কর্মী আরো বেশি অনুপ্রেরণা নিয়ে কাজ করবে।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয় কোন সেলসকর্মী যদি প্রথম চতুর্ভাগের বা মাসের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থ হয় তাহলে যেন তাকে এই সুযোগ দেওয়া হয় যাতে পরের মাসে সে যদি উভয় টার্গেট পরিমাণ সেলস বিক্রি করতে পারে তাহলে তাকে ২ মাসের সমপরিমাণ কমিশন দেওয়া উচিত। এই সিস্টেমে বিক্রয়কর্মীর কাছে দ্বিতীয়বার সুযোগ থাকবে এবং সে হতাশাগ্রস্ত হবে না। ফলে কোম্পানির সেলস কোন মাসে কম হলেও পরবর্তী মাসে সেলস বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকছে।
পরিশেষে, সবসময় সব বিক্রয়কর্মীর বিক্রি ভালো নাও হতে পারে। ম্যানেজারকে সবসময় বিক্রয়কর্মীদের অনুপ্রেরণা, সঠিক প্রশিক্ষণ দিয়ে যেতে হবে। আজকের বাজার খুবই পরিবর্তনশীল। প্রতিনিয়ত নতুন কোম্পানি বাজারে পাল্লা ভারী করছে। তাই সেলস বৃদ্ধি করতে হলে, ম্যানেজারকে বাজার সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে।বাজারের প্রতিটা ছোট বড় পরিবর্তনকে গুরুত্বের সাথে পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
সেলস টিম কে বলা হয় ‘কোম্পানির প্রাণ’, তাই সেলস টিম বা বিক্রয় কর্মীদের কাছে আন্তরিকতা বিক্রি করা ম্যানেজারের জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। বিক্রয়কর্মীর কাছে যদি মনে হয় কোম্পানি তাদের প্রতি যত্ন রাখে, তাহলে বিক্রয়কর্মীর মনে স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা দায়বদ্ধতা চলে আসবে। সেই দায়বদ্ধতা থেকে, বিক্রয়কর্মীরা নিজে থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে কাজ করবে।
লিখাঃ মোঃ সাব্বির আহমেদ
ব্যবসায় প্রশাসন, চতুর্থ বর্ষ
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট।
Leave a Reply